ইসলামী নববর্ষ হউক শুভময় এবং আনন্দের
মুফতি আবু মুহাম্মদ খালিদ কাওসার শাহনগরী
সকালের সূর্য যখন উদয় হয় রাত্রি আত্মগোপন করে, রাতের তিমির এসে দিনের অস্তিত্বকে বিলীন করে দেয়। উদয় হয় নতূন চাঁদ, সূচনা হয় নতূন এক ইসলামী বছরের । এভাবে রাত আসে দিন যায়, মাস আসে বছর যায় আর এই নিয়মই বার্তাবয়ে আনে সমগ্র জাহানের অস্থিত্ব বীলিন হওয়ার। আমদেরকে স্মরণ করে দেয় যে, এক দিন আমদেরকেও চলে যেতে হবে এ পৃথীবি ছেড়ে। বিগত বছরের বিদায়, নতূন বছরের শুভাগমন আমাদেরকে জানিয়ে দেয় মৃত্যূর সংবাদ। রাত-দিনের পরিবর্তনে ক্ষয় হতে থাকে আমাদের হায়াত, ঘনিয়ে আসে মাওত অথচ তা আমাদের বোধগম্য হয় না। নতূন বছরকে হৈ-হুল্লোড়, অরাজকতা ও কুসংস্কৃতি দিয়ে বরণ করি এবং আমাদের গুনাহের পল্লা ভারী করি। তাই আশা করি এই ইসলামী নববর্ষ হঊক আমাদের জন্য শুভময় এবং আনন্দের । পরিবর্তন নিয়ে আসুক আমাদের জীবনে, আমলে, ও চরিত্রে। নিপাতিত হউক সর্বস্তরের জলুম নির্যাতন, হানাহানী, মারামারী ও খুন-খারাবী।
আল্লাহ তাআলা এই মুহররম মাসকে সম্মানী মাস বলেছেন। যাকে কুরআনের ভাষায় “আশ্হুরুল র্হুম” সম্মানী মাস বলা হয়েছে। ইসলামে চারটি সম্মানী মাস রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম মাস, মুহররম মাস। এই সমস্ত মাসে যুদ্ধ, খুন, কতল-কিতাল করা ইসলামে নিষেধ রয়েছে। তাই এই মুহররম মাসেও যুদ্ধ করা , খুন করা, জুলুম নির্যাতন করা নাজায়েয। আর এই মাসকে দিয়েই ইসলামী বছর শুরু করা হয়েছে। তাতে যেন সবাই এই কথার উপলব্ধি করতে পারে যে, মুহররম মাসের মত নতূন বছর হউক সম্মানী, মুক্ত থাকুক সকল প্রকার জুলুম নির্যাতন ও অপত্যাশিত কোন ঘঠনা ও দূর্ঘঠনা থেকে। আর এ মাসে রোজা রাখার ফযিলত বর্ণনা করা হয়েয়েছে হাদীস শরীফে। হুযুর স. এই মাসে বেশি বেশি রোজা রাখতেন।
আর বিশেষ ভাবে আশুরার রোযা রাখতেন , ছাহাবাগন জিজ্ঞেস করলেন, হে রাসুল স., আশুরার রোজা তো ইহুদীরাও রাখে তখন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর করলেন, আমি যদি আগামী বছর বেচে থাকি তা হলে আমি দুটি রোযা রাখব যেন ইবাদতের মধ্যেও ইহুদীদের সদৃশ্য না হয়। তাই দু’টি রোযা রাখা সুন্নাত । আমরা যেন দুটি রোযা রাখি এবং ইবাদতের দ্বারা নতুন ইসলামী বছরকে বরণ করে নিয়। যাতে করে নতূন বছর আমাদের শুভ হয় এবং ভাল যায় তার দোয়া করতে থাকি। আমীন
ইসলামী ক্যালেন্ডার ও নববর্ষঃ
আল কুরাআনে আল্লাহ তায়ালা ফরমান
তরজমা: নিশ্চয় গণনায় মাস আল্লাহর নিকট বারটি। আল্লাহর বিধানে যে দিন হতে আসমান-যমিন সৃষ্টি করা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি সম্মানি এটিই সঠিক দ্বীন সুতারাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের উপর অত্যাচার করো না। আর সমস্ত মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ কর যেমন তারা তোমাদের সবার সাথে যুদ্ধ করে। আর জেনে রেখ আল্লাহ মুত্তাকীনদের সাথে রয়েছে। (সুরা তাওবাঃ ৩৬)
ভাবার্থঃ নিশ্চয় শরীয়তের মধ্যে আল্লাহর নিকট গণনায় মাস বারটি। আসমান-যমিন সৃষ্টি করার পর থেকেই। তন্মেধ্যে চারটি মাস (রজব, যিলক্বদ ও যিলহিজ্জা, মুহাররম) সম্মানিত মাস এটাই দ্বীন মুসতাকীম (অর্থাৎ গণনায় মাস বারটি)। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত মাস মানা দ্বীনে মুসতাকীম বা সোজা রাস্তা) এই মাসগুলির মধ্যে গুনাহ, ফিত্না ফাসাদ করে নিজের উপর জুলুম কর না। এবং সর্ব অবস্থায় সমবেত হয়ে, মুশরিকদের সাথে লড়াই ও যুদ্ধ কর যেমন তারাও তোমাদের বিরুদ্ধে সমবেত হয়ে যুদ্ধ করে। মুশরিকদের জনবল ও প্রাচুর্য দেখে ভয় পেও না। জেনে রাখ আল্লাহ শুধু মুত্তাকী মুমিনদেরই সাথী। তিনি সব সময় তাদেরকেই কামিয়াব করবেন।
সংক্ষিপ্ত তফসীর: উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহ তাআলা আইয়্যামে জাহিলীয়াতের একটি রসমকে খন্ডন করেছেন এবং মুসলমানদেরকে তা বর্জন করার উপদেশ দিয়েছেন। সমস্ত নবী-রাসুলগণের শরীয়তেও মাস বারটি ছিল এবং তন্মধ্যে চারটি হারম বা সম্মানি ছিল। আর মক্কায় আরবরা যেহেতু ইব্রাহীম (আঃ) এর বংশধর ছিল তাই তারা সবাই ইব্রাহীম (আঃ) এর ধর্ম ও শরীয়তকে মানত আর তাঁর ধর্মেও চারটি মাস অর্থাৎ যিলক্বাদা, যিল হিজ্জা, মুহাররম ও রজব সম্মানি ছিল। এই মাসগুলোতে যুদ্ধ হত্যা, হানাহানি নিষেধ ছিল। আরবরা জাহিলী যুগে দাঙ্গাবাজ ছিল। খুন খারাবি তাদের পেশা ছিল বিধায় এই মাসগুলির সম্মান রক্ষা করা তাদের জন্য বড় মুশকিল ছিল। কিন্তু এই মাসগুলি যে সম্মানি তা তাদের আক্বীদা বিশ্বাস ছিল। তাই যখন লড়াই যুদ্ধ করতে করতে উক্ত মাসগুলো উপস্থিত হয়ে যেত তখন তারা সম্মান রক্ষা করার জন্য ঐমাসগুলো পরিবর্তন করে ফেলত-যেমন যদি যুদ্ধরত অবস্থায় মাহে মুহাররম এসে যেত তখন সবাই মিলে একত্রিত হয়ে এই ঘোষণা দিত যে, এ বছর এই মাস মুহাররম হবে না বরং পরবর্তী মাস মুহাররম হবে আর এ মাস হবে সফর মাস। এভাবে মাসের নামগুলি পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে ফেলত। তাই কোন কোন বছর চৌদ্দ মাসে হত। মাসের সংখ্যা বেড়ে যেত অর্থাৎ তারা চারটি মাসের সম্মানতো করত কিন্তু আল্লাহর বিধান মতে নয় বরং তাদের মনগড়া খেয়াল খুশি মোতাবেক। তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের এই মনগড়া মতবাদকে দূর করার জন্য এই আয়াত নাযিল করে মাসের বিধান বয়ান করেন। আল্লাহপাক উক্ত আয়াতে ফরমান, ইসলামী শরীয়তে আল্লাহর বিধান হল এক বছরে মোট মাস বারটি। তন্মধ্যে কারো পরিবর্তন ও পরিবর্ধন চলবে না এটা আল্লাহ পাক রোজে আযল হতে নির্ধারিত করে রেখেছেন। তার মধ্যে চারটি মাস যে সম্মানি তাও নির্ধারিত ও নির্দিষ্ট। এ সমস্ত বিধানকে মেনে চলাই হচ্ছে “দ্বীনে মুসতাকীম” সোজা রাস্তা, এতে কোন ইনসানের কম-বেশী ও পরিবর্তন পরিবর্ধন করার অধিকার নাই।
ইসলামী ক্যালেন্ডার ও নববর্ষঃ
বিশুদ্ধ মত মতে হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) খিলাফতের যামানায় ছাহাবায়ে কিরামগণ সহ পরামর্শক্রমে করে হুজুর (সঃ) এর হিজরত থেকে মুহাররম মাসকে প্রথম মাস হিসাব করে ইসলামী গণনা শুরু হয়। আর ইসলামের মধ্যে শুধু চাঁদের গণনাই (চন্দ্র ক্যালেন্ডার) গ্রহনযোগ্য । যদিও বা অন্যান্য গণনায়ও মাস বারটি। (কুরতুবী ৮/১৩৩) তফসীরে মাযহারীতে আছে, রোযা, হজ্ব ও যাকাতের জন্য শুধুমাত্র চাঁদের মাসই গ্রহণযোগ্য। (মাযহারী ৪/২০১) তার প্রমাণ কোরআনের অন্য আয়াত ও হাদীস দ্বারাও বুঝা যায়। যেমন সূরা বাক্বারার আয়াত “ তোমাদের নিকট তারা জিজ্ঞেস করে নতুন চাঁদের বিষয়ে। বলে দাও। এটি মানুষের জন্য সময় নির্ধারণ ও হজ্বের সময় ঠিক করার মাধ্যমে। (সূরা বাক্বারা-১৮৯)। আর হাদীস শরীফে আছে, হুজুর (সঃ) ইরশাদ করেন, “ছোমু লি রুয়েতিহি ওয়া আফতিরু লি রুয়েতিহি” (অর্থাৎ চাঁদ দেখে রোযা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোযা ছাড়। মেশকাত) তাই শরীয়তে মুহাম্মদীয়ায় শুধুমাত্র চাঁদের মাসই ইবাদতের জন্য (যেমন রোজা. হজ্ব, যাকাত ইত্যাদির) গ্রহনযোগ্য।
তার কয়েকটি কারণ রয়েছে। ইসলাম হচ্ছে সহজ সরল পথের নাম। কোন কঠিন কাজ শরীয়তের বিধানে নেই। সব সময় ইসলাম এদিকে খেয়াল রাখে যে, কিভাবে ইসলামের হুকুম সর্বসাধারণ মানুষ অতি সহজে আদায় করতে পারে। তাই এই গণনার মধ্যে চাঁদের মাসকে গ্রহণ করা হয়েছে। যেন সর্বস্তরের লোক দিন মাস তারিখ চাঁদ দেখে নির্ণয় করতে পারে। গ্রামের লোক, শহরের লোক। অজ্ঞ-বিজ্ঞ, ছোট-বড় সকলে চাঁদ দেখে শরীয়তের হুকুম-আহকাম আদায় করতে পারবে। আর যদি সূর্যের হিসাব ধরা হত তখন হিসাব বিজ্ঞান পড়তে হত বা যারা হিসাব জানে তারা ব্যতীত অজ্ঞ ব্যক্তিরা তা জানতে পারত না তখন তাদের জন্য এটা কঠিন হয়ে যেত।
আর একটি হেকমত তার মধ্যে নিহিত রয়েছে যে চাঁদের মাস গুলি প্রতি বছর ঘুরতে থাকে নির্দিষ্ট কোন এক দিনে মাস শুরু হয় না প্রতি বছরে মাস সামনে আসতে থাকে তাই যখন চাঁদের মাস হিসেবে রোযা ও হজ্ব করা হয় তখন বছরের প্রতিটি দিনে ও মুহুর্তে তার ইবাদত আল্লাহর যিকির সংঘটিত হবে।
মাসায়িল ও আহকামঃ
উক্ত আয়াত হতে কয়েকটি মাসয়ালা মাসায়িল প্রতীয়মান হয়ঃ
১. ইসলামী মাসগুলির যে তরতীব ও নাম প্রচলিত এটা কোন মানুষের বানানো নয় বরং স্বয়ং আল্লাহতালার নির্ধারিত বিধান।
২. ইসলামী যত হুকুম-আহকাম ও ইবাদত রয়েছে সবগুলি চাঁদের মাস হিসেবে পালন করা জরুরী। অন্যান্য কোন গণনা হিসেবে আদায় করলে হবে না। যেমন হজ্ব ইত্যাদি।
৩. যেহেতু ইসলামের বিধান চাঁদের মাসের সাথে সম্পৃক্ত তাই চাঁদের মাসের হিসাব রাখা ফরযে কিফায়া। (মায়ারিফুল কোরআন)
৪. চারটি সম্মানিত চন্দ্র মাসে ফিতনা ফাসাদ করা ও দাঙ্গা হাঙ্গামা করা নাজায়েজ। হ্যাঁ, কিন্তু কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করা প্রথম যুগে না জায়েজ ছিল কিন্তু পরবর্তীতে সে হুকুম মানসুখ, রহিত, হয়ে গেছে। অর্থাৎ কাফেররা যদি মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন আত্মরক্ষা মূলক প্রতিরোধ করা জায়েয হবে। আর যদি তারা এ মাসগুলিতে যুদ্ধ শুরু না করে তখন মুসলমানরা যুদ্ধ শুরু না করা উত্তম (মায়ারিফুল কোরআন)