ঈদের আহকাম
ঈদের আহকাম:
মুফতি খালিদ কাওছার শাহনগরী
- হযরত আবু সায়ীদ খুদরী রা. বলেন, ঈদুল ফিত্র এবং আযহা দিন যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ময়দানে আসতেন, তখন সর্ব প্রথম তিনি নামায পড়াতেন অতপর মুসাল্লির সম্মুখ হয়ে নছিহত করতেন ( অর্থাৎ খোতবা দিতেন)। বোখারী-মুসলিম
- হযরত ইবনে ওমর রা. বলেন, নাবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আবু বকর ও ওমর রা. ঈদের নামায খোতবার আগে আদায় করতেন । বোখারী-মুসলিম
- হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, নাবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন দুই রাকাত নামায পড়তেন, তার আগে বা পরে কোন নামায আদায় করতেন না। বোখারী-মুসলিম
- হযরত আনাস রা. বলেন, নাবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন, যতক্ষন পর্যন্ত খেজুর ভক্ষন করতেন না, মাঠে রওয়ানা হতেন না আর খেজুুর বে-জোড়া খেতেন। বোখারী-মুসলিম
- নবী করীম স. ঈদের দিন রাস্তা পরিবর্তন করতেন (এক রাস্তায় যেতেন অন্য রাস্তায় আসতেন)। বোখারী-মুসলিম
দু’ঈদের সুন্নাত সমুহ
১) ঈদের দিন অতি শীগ্রই ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া এবং ফজরের নামাজ মহল্লার মস্জিদে জমাতের সহিত আদায় করা। ২) মিসওয়াক করা। ৩) গোসল করা। ৪) নতুন বা ধোয়াকৃত সুন্দর কাপড় পরিধান করা। ৫) আতর খুশবো ব্যবহার করা। ৬) সকালে সকালে ঈদগাহ রওনা হওয়া। ৭) পায়ে হেঁটে ঈদগাহ যাওয়া। ৮) এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া অন্য রাস্তা দিয়ে আসা। ৯) ঈদুল ফিতরে আস্তে তাকবীর পড়তে পড়তে ও ঈদুল আযহায় বড় আওয়াজে পড়তে পড়তে ঈদগাহ যাওয়া। তক্ববীর: (আল্লাহু আক্বার আল্লাহু আক্বার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আল্লাহু আক্বার আল্লাহু আক্বার ও লিল্লা-হিল হামদ)। ১০) ঈদুল ফিতরে নামাজের বে-জোড়া খোরমা-খেজুর খাওয়া। যদি খেজুর না থাকে মিষ্টি জাতীয় কিছু ভক্ষণ করা। ১১) ঈদের নামাজ বড় মস্জিদে জায়গা হওয়া সত্ত্বেও ঈদগাহ বা মাঠে আদায় করা। ১২) ছদক্বায়ে ফিতর ঈদের নামাজ পড়ার পুর্বে আদায় করা। ১৩) ঈদের নামাজের পুর্বে ঘরে বা মাঠে আর ঈদের নামাজের শেষে মাঠে কোন নফল নামাজ না পড়া, যদি পড়ে মাকরূহ হবে।
মুছাফাহ ও মু’য়ানাক্বা :
এক মুসলমান অন্য মুসলমান ভাই এর সহিত দেখা হলে প্রথমে সালাম করা, মুছাফাহ করা তারপর মুয়ানাক্বা করা সুন্নত। তার উপর হাদীস শরীফে অনেক উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু শরীয়তের প্রতিটি আহকামে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আদেশ ও নির্দেশ রয়েছে, তা উপেক্ষা করে কোন ইবাদত করলে তা আল্লাহ্ তায়ালার নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন নামায একটা উত্তম ইবাদত, ঈমামের পর নামাযের স্থান কিন্তু সূর্যোদয়, তীব্র ও সূর্যাস্তের সময় নামাজ পড়া হারাম। সে রকম রোযা একটা বড় ইবাদত কিন্তু ঈদের দিন রোযা রাখা হারাম।
তেমনি মুছাফাহ ও মুয়ানাক্বা সুন্নতের কাজ তার জন্য কিছু বিধান রয়েছে। যখন প্রথম দেখা হয় তখন মুছাফাহ ও মুয়ানাক্বা করা সুন্নত। কিন্তু একসাথে ঈদগাহ গিয়েছে এক সাথে নামায পড়েছে একসাথে খোতবা শোনার পর উঠিয়া মুছাফাহ ও মুয়ানাক্বা যে প্রথা প্রচলিত তা কোন হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে কোন সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) বা আয়ীম্মায়ে মুজতাহীদিন (রহঃ) হতে প্রমাণ নাই, যার কারণে ফেক্বাহবিদগণ ইহাকে বেদআত বলেছেন। ফতোয়া শা’মীতে আছে, আল্লামা ইবনে হাজর শাফিয়ী বলেছেনঃ “লোকেরা নামাযের পর যে মুছাফাহ করে তা বেদআতে মাজরুহ শরীয়তে মুহাম্মদীয়ায় তার কোন প্রমাণ নাই” (ফঃ শা’মী) ‘মাজালিসুল আবরার’ গ্রন্থে রয়েছে, “সাক্ষাত ছাড়া অন্য অবস্থায় মুছাফাহা করা, যেমন জুমা ও ঈদের নামাযের পর যেটা আমাদের জামানায় প্রচলিত, হাদীসে তার কোন ্উল্লেখনেই। সেজন্য এটা একটা দলিল বিহীন কাজ। আর এ কথা মুহাক্বক যে, যে কাজের কোন দলিল নাই তা আমল করা মারদুদ (অযোগ্য/না জায়েয) !” (ফঃ রহীমিয়া ৩ ঃ ৭২) ইবনের হাজ্ব মালেকী ‘মুখদুল’ নামক গ্রন্থে
লিখেছেন, “এটা (নামাযের পর মুছাফাহ) বেদআত। শরীয়তে মুছাফাহ্ করার সময় হল মুসলমানের সাথে প্রথম সাক্ষাতকালে নামাযের শেষে নয়। আর এ রকম যারা খেলাফে সুন্নত কাজ করবে তাদেরকে বাধা দেওয়া উচিত।” (ফঃ শা’মী, খন্ড-৬, পৃষ্টা-৩৮১, ফঃ রহীমিয়া ৩ ঃ ৭২)
আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী স্বীয় গ্রস্থ মেরক্বাত শরহে মিশকাত এ লিখেছেন নিশ্চয় শরীয়তে মুছাফাহার সময় হল প্রথম সাক্ষাতের সময়। মানুষ বিনা মুছাফাহ সাক্ষাত করে এবং কথা-বার্তা বলে পরে যখন নামায শেষ করে তখন মুছাফাহ করে, এটা কিসের সুন্নত। সেজন্য অনেক ফুক্বাহারা এ নিয়মটা মাকরূহ ও বেদআত এ সায়্যিয়া বলেছেন। (ফঃ রহীমিয়া) ফতোয়া শা’মীতে লিখেছে, “নিশ্চয় সর্ব অবস্থায় নামাযের পর মুছাফাহ করা মাকরূহ কেননা সাহাবায়ে কেরামগণ নামাযের পর কখনো মুছাফাহ করেননি এবং এটা রাফেযিদের তরীকা। (ফঃ শা’মী ৬ ঃ ৩৮১) সে জন্য আমাদের দেশে বা এখানে যে প্রথা প্রচলিত রয়েছে, ঈদের নামায শেষ করার পর মুছাফাহ ও মুয়ানাক্বা করা,তার কোন প্রমাণ হাদীসে, সাহাবায়ে কেরামের আমলে ও আয়্যিম্মা মুজতাহীদিন হতে পাওয়া যায়না। তা বেদআত ও মাকরূহ, এটা বর্জন করা অতি জরুরী।
সহায়ক গ্রন্থ ঃ বোখারী, মুসলিম, তিরমীযি, মেশকাত শরীফ, ফঃ শা’মী, ফঃ আলমগীরি, ফঃ ক্বাযীখান, বাহরুর বায়েক, বাদায়েইস সানায়ে, ফঃ রহীমিয়া।
ঈদের নামাযের তাকবীর বলার পদ্ধতি
- হযরত সায়ীদ বিন আ’ছ রা. আবু মুছা আশয়ারী ও হুযাইফা বিন ইয়ামান রা. কে জিজ্ঞাসা করলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু… ঈদুল ফিত্র ও ঈদুল আযহায় তাকবীর বলার পদ্ধতি কি ছিল? তখন আবু মুছা রা. বলেন চার তাকবীর বলতেন জানাযার নামাযের মত। (অর্থাৎঃ তাকবীরে তাহরীমা ও রুকুর তাকবীর সহ চার তাকবীর বলতেন)। আবু দাউদ-১/১৬৩
- হযরত ইবনে মাসউদ রা. এভাবে নামায পড়াতেন। (তিরমিযী ১/১২০)
- হযরত আনাস, ্ইবনে আব্বাস, মুগীরা ইবনে শ্য়াবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম ৬ তাকবীর দারা ্ঈদের নামায পড়াতেন. ( মু. আ: রায্যাক , কিতাবুল আছার ১/৫৩৭)
- ইমাম মুহাম্মাদ ইমাম আবু হানিফা থেকে,তিনি ইমাম হাম্মাদ থেকে, তিনি ইমাম ইবরাহীম নাখয়ী, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্নণা বরেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ কুফার মাসজিদে ৬ তাকবীরের সহিত ঈদের নামায শিক্ষা দেন। কিতাবুল আছার ১/৫৩৭
- হযরত ওমর রা: যামানায় মদীনা শরীফে জানাযা ও ঈদের নামায (রুকু সহ) ৪ তাকবীর দ্বারা আদায় করার উপর ইজমা গঠিত হয় । (তাহাবী ২৮৬)
যারা বলে ৬ তাকবীরে ঈদের নামায পড়া শুদ্ধ নয় তারা একটু ভেবে দেখবেন কী, যে সমস্ত ছাহাবাগন. (রাদী.) ৬ তাকবীরে ঈদের নামায পড়েছেন তারা কি ভুল পথে ছিলেন? এ ধরনের কথা সমাজে বিভ্রন্তি ছড়ানো ছাড়া আর কিছুই নয়।
ছহী মত মোতাবেক ঈদের নামায ওয়াজিব। ঈদের নামাযের সময়, সূর্যোদয়ের ২০মি: পর থেকে সূর্য তীব্র হওয়া পর্যন্ত। যাদের উপর জুমার নামায ওয়াজিব তাদের উপর ঈদের নামায ওয়াজিব। যেমন সাবালগ, মুক্বিম, পুরুষ ও সুস্থ মস্তিষ্ক ওয়ালাদের উপর ঈদের নামায ওয়াজিব। ঈদের নামায হচ্ছে, অতিরিক্ত ছয় তক্ববীরের সহিত দু’রাকাত নামায জমাতের সাথে আদায় করার নাম। নামায শেষে ইমাম মুসল্লিদের সম্মুখ হয়ে খোতবা দিবে। খোতবা শুনা ওয়াজিব। প্রথম খোতবা ৯ তাকবীর, দ্বিতীয় খোতবা ৭ তাকবীর দ্বারা শুরু করা মুস্তাহাব। (ফঃ শামী , আলমগীরী)
মাসআলাঃ ঈদের নামাযের জন্য আযান, ইকামত নেই। ঈদের নামায জামাত ব্যতীত আদায় হয় না। জামাতের জন্য ইমাম ছাড়া তিন জন হওয়া জরুরী।
ঈদের নামায পড়ার নিয়মঃ প্রথমে মনে মনে নিয়ত করবে আমি অতিরিক্ত ৬ তাকবীরের সাথে ঈদুল ফিত্র/ আযহার নামায আদায় করিতেছি। অতপর ইমামের সহিত আল্লাহু আকবর বলে হাত বাঁধবে, এবং সুবহানাকা পড়ার পর অতিরিক্ত তাকবীর থেকে ৩টি তাকবীর বলার জন্য ইমামের সহিত হাত উঠাবে এবং প্রথম ও দ্বিতীয় তাকবীর বলে হাত ছেড়ে দিবে, তৃতীয় বার হাত উঠাবে এবং তাকবীর বলে হাত বাঁধবে তারপর কিরাত শুরু করবে। দ্বীতিয় রাকাতে সুরা ফাতিহা ও কিরাত পড়ার পর রুকুতে যাওয়ার আগে, প্রথম রকাতের মত, হাত উঠায়ে বাকি ৩টি তাকবীর বলবে এবং চতুর্থ তাকবীর বলে রুকু করবে।
মাসআলাঃ ইমাম রুকুতে চলে গেছে, তখন কেও যদি উপস্তিত হয়, তখন যদি মনে করে তাকবীর বলে রুকুতে শরীক হতে পারবে, তখন বলে নিবে। যদি মনে করে তাকবীর বলতে গেলে ইমাম রুকু থেকে উঠে যাবে তখন রুকুতে চলে যাবে আর রুকুতে তাসবীহ পড়ার পরিবর্তে তাকবীর পড়বে, হাত উঠানো ব্যতীত।
মাসআলাঃ যদি কেও এক রাকাত না পায় তখন ইমাম সালাম ফেরানোর পর ঐ রাকাত আদায় করার সময় প্রথম সুবহানাকা , সুরা, কিরাত পড়ার পর রুকুতে যাওয়ার পূর্বে ৩ তাকবীর বলে নিবে, চতুর্থ তাকবীর বলে রুকু করবে।
মাসআলাঃ কোন ব্যক্তি যদি অন্য মাযহাবের ইমামের সহিত নামায পড়ে তখন ঐ ইমাম যত তাকবীর বলবে সেও তত তাকবীর বলবে। যদি ইমাম এত তাকবীর বলে যা কোন হাদীসে নায় তখন ইমামের অনুসরণ করবে না।
মাসআলাঃ যে মুসল্লি শুধূ শেষ রাকাত পেয়েছে, সে উঠে প্রথম সুবহানাকা পড়ার পর তিন তাকবীর বলবে, অতপর কিরাত পড়বে। দ্বিতীয় রাকাত সুরা কিরাত পড়ার পর তিন তাকবীর বলবে, চতুর্থ তাকবীর বলে রুকু করবে। (ফঃ আলমগীরী)
মাসআলাঃ যে ঈদের নামায পায় নায় সে একাকি ঈদের নামায আদায় করতে পারবে না। কারণ ঈদের নামায জামাত ব্যতীত আদায় হয় না। হাঁ যদি কয়েক ব্যক্তি এক সাথে নামায না পায় তখন তাদের জমাতের সহিত আদায় করা ওয়াজিব হবে।
ই-মেইল: sunnahus@gmail.com web: daruliftabd.org